
প্রকাশিত: Fri, Dec 29, 2023 10:49 PM আপডেট: Mon, Jun 23, 2025 2:00 PM
এক কালচার ইগনোর করলে আরেক কালচার ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে যাবে
মোহাম্মদ আবদুল বাতেন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারের সঙ্গে কথা বলেছেন। তা নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। অনেকে বলছেন, এটা আসলে টিকটক, ইউটিউবারদের মতো শ্যালো, সাব কালচারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এতে সমাজে ভুল বার্তা যাবে। যারা এমন সমালোচনা করছেন তাদের সঙ্গে মোটা দাগে আমার দ্বিমত। আমার মতে, সমালোচনাটা ভুল জায়গায়। আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সিআরআই-এর যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে এসব ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেখান থেকে আপনি সিলেকটিভ কিছু নাম নিয়ে মানহীনতা, রুচিহীনতার প্রশ্ন তুললে আপনার চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও একপক্ষীয় উন্নাসিকতাই বের হয়ে আসে। কারণ আপনিও তাদের একটা মাপকাঠি দিয়ে বিবেচনা করছেন। তাদের নাগরিক প্রতিনিধি হিসেবে না দেখে তাদের মেধা ও জ্ঞান চর্চার লেন্সে দেখতে চাইছেন। আবার জ্ঞান চর্চা বলতে আপনি সম্ভবত একাডেমিক ও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার নির্ভর পেশাজীবিতাকে সফল ও মডেল ধরে বাকি সবাইকে আদারিং করার একটা ট্রাপে পড়ে গেছেন এবং আমাদের সমাজে সফলতাকে খুব ন্যারো অর্থে পেশাগত সফলতা হিসেবে দেখা হয়। জ্ঞান চর্চাকে একাডেমিক বাউন্ডারিতে বেধে রাখা হয়। এতে সিটিজেন নলেজ, সিটিজেন উইজডম ইগ্নোরড হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ট্রাডিশনাল নলেজ নিয়ে গবেষণা করে পেপার লিখে বড় গবেষক সাজা ব্যক্তি কৃষককে চাষা ভূষা মূর্খ মনে করে।
প্রধানমন্ত্রীর সেই অনুষ্ঠানে সেজুতি সাহার মতো উদীয়মান বিজ্ঞানী ছিলো। এনায়েত চৌধুরির মতো বুয়েটের শিক্ষক ছিলো। আদিবাসী প্রতিনিধি ছিলো। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ছিলো। এদের সবাইকে বাদ দিয়ে আপনি তৌহিদ আফ্রিদি, রাফসান, রাবা হকদের যখন ফোকাস করেন তখন আপনার সমালোচনা অবজেক্টিভিটি হারায়। টার্গেটেড বিদ্বেষে পরিণত হয়। সেজুতি সাহারা যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাটা যৌক্তিক হয় তাহলে রাফসানেরটা কেন অযৌক্তিক হবে? সেতো নাগরিক এবং সমাজের একটা অংশ তাকে ফলো করে। রাবা হক ও তরুণ প্রজন্মের অনেকের আইডল। সেই কয়েক বছর আগে বইমেলার বেস্ট সেলার লেখকদের একজন ছিলো। আসলে বদলে যাওয়া সোশ্যাল ল্যান্ডস্কেপটা আপনি ধরতে পারছেন না। আপনি এখনো ক্লাসিকাল কিংবা নিও ক্লাসিক্যাল যুগের মেইন স্ট্রিম মিডিয়া কাউকে পরিচিত করালে সেই সেলিব্রেটি এই তত্ত্বে আটকে আছেন। কিন্তু নিও লিবারেলিজমের এই যুগে, প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতিতে পৃথিবীর টপ টেন সেলিব্রেটিদের মধ্যে কার্দাশিয়ান ফ্যামিলির চারজন- যারা শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ দেখিয়েই কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর আইডল। কার্দাশিয়ান ফ্যামিলির কাইলি জেনার কিংবা কিম কার্দাশিয়ান একটা ইন্সটা পোস্টের জন্য যতো টাকা চার্জ করে ততো টাকা আমাদের দেশের টপ এক্টর এক বছরে ইনকামও করে না। এই পরিবর্তনের ঢেউয়ের বাইরে তো বাংলাদেশ নয়।
এখন তো আমরা দুইটা প্যারালাল জগতে বাস করছি। একটা আপনার চারপাশের জগৎ, আরেকটা মুঠোফোনের ভার্চুয়াল জগৎ। দুই জগতের বাউন্ডারি প্রায়ই অভারল্যাপ করে। যতো দিন যাচ্ছে ততোই অভারল্যাপিং বেশি হচ্ছে এবং একসময় মুঠোফোনের ভার্চুয়াল জগৎ বাস্তবের জগতকে ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন বেশি দূরে নয়। এই বাস্তবতা আপনি ধরতে না পারলে আপনার ব্যর্থতা। কিন্তু রিয়েলিটি হচ্ছে, ইন্ডিভিজুয়ালিজম এবং ফোমো (ঋবধৎ ড়ভ গরংংরহম ঙঁঃ) এর ঢেউ আমাদের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি করে দিয়েছে। এইসব ঋঙগঙ, নার্সিসিজম সব সময় ছিলো। এইগুলো মানুষের ইনবিল্ট সাইকোলজি। আগেও পাশের বাসার ভাবী থেকে আমার শাড়িটা একটু আলাদা ও গর্জিয়াস না হলে ইজ্জত থাকবে না, এই ফিলিং ছিলো। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে আপনার রিচ বেড়ে যাওয়ায় বাউন্ডারি বেড়েছে। এখন আপনি বাকি সবার থেকে আলাদা, গর্জিয়াস হতে চান। এই ব্যতিক্রম হওয়ার বাসনা, এই দৃষ্টি আকর্ষণের বাসনার বর্ধিত বাউন্ডারির কারণে আপনার মনে হতে পারে সে রুচিহীন। কিন্তু আপনি আপনার রুচির যে সংজ্ঞা, সেইটা দিয়ে আরেকজনকে সংজ্ঞায়িত করাটা কতটুকু যৌক্তিক? আগেও ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে খেলে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতাম। সেটাই এখন ফুড ভøগ। তার মানে প্র্যাকটিস সবই ছিলো শুধু রিচ, মিডিয়া আর বাউন্ডারি বড় হয়েছে। পাড়ার মোড়ের আড্ডাকে যদি আপনি বলছেন প্রাণের আড্ডা, তাহলে যে প্রজন্ম বড়ই হয়েছে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে তার ভার্চুয়াল আড্ডাকে রুচিহীন হিসাবে ট্যাগ করে দেওয়া কি আপনার জ্ঞান বুঝায় নাকি সমাজের পরিবর্তন বুঝতে না পারার অক্ষমতা বুঝায়? প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যেসব সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার আমন্ত্রিত হয়েছে, আমার অবজারভেশন বলে তাদের খুব ইন্টেলজেন্টলি পিক করা হয়েছে এবং ডাইভার্স ফিল্ড থেকে। ফুড ব্লগিং, লাইফ স্টাইল, ট্রাভেল, সোশ্যাল এনোমালি, ইভেন্ট কমেন্টেটর, মোটিভেশনাল এমন নানা সেক্টরকে রিপ্রেজেন্টেশন করানোর চেষ্টা ছিলো। এইভাবে চিন্তা করেন- আমাদের রিয়েল ওয়ার্ল্ড সমাজে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, গায়ক, ভ্রমণকারী, ব্যবসায়ী এমন নানা প্রতিনিধিত্ব থাকে। এবার যারা ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে সেই অনুষ্ঠানে যেতে পেরেছে তাদের কন্টেন্টের ক্ষেত্র দেখেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গায়ক, শিক্ষক সব পাবেন। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা তারা ভøগিং করেন? কন্টেন্ট ক্রিয়েটর এই জায়গায়? তাদের কাজের ক্ষেত্র বুঝতে না পারা তো আপনার সমস্যা। কিন্তু আপনার ওয়ার্ল্ডের বাইরে যে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড দাঁড়িয়ে গেছে সেখানে তারা তো প্রতিনিধি আর প্রধানমন্ত্রী সব প্রজন্মকে রিচ করতে হলে এদের ইগ্নোর করার সুযোগ তো নেই।
তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা আমরা যেটা মিস করেছি- এই অনুষ্ঠানে যারা দাওয়াত পেয়েছে তারা উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি। এখানে গ্রাম বাংলার, খুব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা আমন্ত্রণ পায়নি। এখানেও শ্রেণিবৈষম্য প্রবল ছিলো। রাফসান, রাকিন আবছার, রাবা হক’রা উচ্চ মধ্যবিত্ত, বাংলিশ টোনে কথা বলা, তৌহিদ আফ্রিদিরা যে লাইফ স্টাইল প্রমোট করে এটা শহুরে মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, কিংবা রাকিন আবছার যে লাইফ স্টাইল প্রমোট করে সেটা গুলশান, বনানী কিংবা নিউইয়র্কের। আয়মান সাদিকরা যেসব আইইএলটিএস কিংবা শর্টকার্টে সফল হওয়া, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রমোট করে এটা দেশের কোটি কোটি নিম্নবিত্ত ও গ্রামীণ তরুণের ‘কাপ অব টি’ নয়। রাফসান সাবাব’রা যে সেলিব্রেটি গসিপকে প্রমোট করে, এটা একটা শহুরে সুবিধাভোগী অংশের প্রতিনিধিত্ব মাত্র। এখানে টিকটকার অপু, হিরো আলম, প্রিন্স মামুনরা জায়গা পায়নি। তার মানে কি অপু, হিরো, প্রিন্স মামুনরা ভালো কন্টেন্ট বানায়? তা নয়। তারা সেটাই বানায় যেটা তাদের দর্শকরা চায়। যুগে যুগেই সমাজে এই শ্রেণিবিন্যাস ছিলো, সেই শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী বিনোদন, শিক্ষা, সংস্কৃতির কনটেন্ট ভিন্ন হয়। হাওয়া কিংবা আয়নাবাজি শহুরে মধ্যবিত্তের ছবি আবার ‘খাইছি তোরে’, ‘যাবি কই’ এইগুলোকে গ্রামীণ কিংবা খেটে খাওয়া কম শিক্ষিত মানুষের বিনোদন হিসাবে প্রমোট করা হয়েছে। সমালোচনাটা হওয়া উচিত ছিলো সেই রিজেপেন্টেশন নিয়ে। শ্রেণিবৈষম্য নিয়ে। কিন্তু আমরা অনেকেই সমালোচনাটা করছি ভুল জায়গায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের মানুষের রুচিকে উন্নত করতে কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছিলো? প্রথম আলোতে শেখ সাবিহা এই প্রশ্নগুলো চমৎকারভাবে তুলেছেন। উনি প্রিন্স মামুনরা কীভাবে বেদের মেয়ে জোৎস্নার জায়গায় সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের বিনোদনের জায়গাটা টিকটকের ফিল্টার দিয়ে নিয়ে ফেলছে সেটার ক্রিটিকাল আলোচনা করছেন। সেই জায়গা নিয়ে আমাদের আলোচনা নেই, আলোচনা প্রধানমন্ত্রী কেন টিকটকারদের আমন্ত্রণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী ১৮ কোটির প্রতিনিধি তাই সমাজের সব স্তরের, প্রজন্মের ভাবনার সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, এটাই স্বাভাবিক। বরং আমাদের প্রশ্ন তোলা উচিত ছিলো- তারা আইডল কীভাবে হলো? বাস্তবতা হলো তাদের অনেকের মিলিয়ন ফলোয়ার। এই বাস্তবতা কি অস্বীকার করা যাবে? পপুলারিজমের এই যে ট্রাপ, সেই ট্রাপ কীভাবে তৈরি হয়েছে সেটা নিয়ে আলোচনা না করে, কেন তারা সেলিব্রেটি- এইটা বলে তরুণ প্রজন্মকে আন্ডারমাইন করাটা আপনার একধরনের স্নোভিজম এবং শ্যালো চিন্তা। শেখ সাবিহা সুন্দর করে বলেছেন, দেশে সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। শিল্পকলা একাডেমি কি উপজেলা পর্যায়ে আছে? মাঠ নেই। সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ তৈরি করা হয়নি। এর বাইরে আছে আরেক শ্রেণির রাজনীতি বিমুখ ক্যারিয়ার ভিত্তিক সফলতার প্রচার। তাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা রাজনীতিতে আসে না, নুরুরা বিকশিত হয় না। প্রিন্স মামুনরা, রাফসানরা, রাকিনরা বিকশিত হয়। এইবার বুঝলেন সমস্যা কোথায়? একটা কালচারকে ইগ্নোর করলে আরেকটা কালচার ভিন্নভাবে দাঁড়িয়ে যাবে। কাকে কে আইডল মানবে, ভার্চুয়াল এই যুগে আপনি তিরস্কার করে নির্ধারণ করে দিতে পারবেন না। আপনি পরিবেশ তৈরি করে দেন, বাকি ব্যাপারগুলো সোশ্যাল মেশিন নিজেই নিজের মতো করে নেবে। রাজনীতিতে তরুণদের যতো নিরুৎসাহিত করবেন ততোই সে সামাজিক অসাম্য, দুর্নীতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংবেদনশীলতা হারিয়ে গাড়ি, বাড়ি, শো অফ এমন সাব কালচারে আসক্ত হতে থাকবে। এবার চিন্তা করে দেখেন, আপনি নিজেও কি প্রমোট করেছিলেন? জোনায়েদ সাকিরা রাস্তায় চিল্লায়, অধিকারের কথা বলে কিন্তু জনসমর্থন নেই। কিন্তু রাফস্যান দ্য ছোট ভাই-এর মিলিয়ন ফলোয়ার। তাই প্রধানমন্ত্রী সাকিদের ইগ্নোর করবেন, রাফসানদের জায়গা দেবেন। কারণ রাফসানরা ঘুমপাড়ানি প্রজন্ম তৈরিতে সহায়তা করছে, যারা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবে না। তারা দিবা স্বপ্ন দেখাবে। মালদ্বীপে হলিডে, লেটেস্ট মডেলের কার, দামি এপল ওয়াচ- এটাই তো সফলতা হিসাবে প্রমোট করেছেন, তাহলে এই ইনফ্লুয়েন্সারদের দোষ কোথায়? লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
